চাপে রয়েছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম : ডয়েচে ভেলে
নিজস্ব প্রতিবেদক
গণমাধ্যম সাধারণ মানুষের কথা বলে। সাধারন মানুষের সমস্যা ,সমাধান, হাসি, কান্না, দু:খ সকলের সামনে তুলে ধরে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পারছে কিংবা করতে দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জার্মানভিত্তিক সংবাদসংস্থা ডয়েচে ভেলে। প্রতিক্ষণের পাঠকদের জন্য ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
গ্রেপ্তার, হয়রানি, হামলার শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা৷ সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ওপর রয়েছে অঘোষিত চাপও৷ মানবাধিকার কর্মী মীনাক্ষী গাঙ্গুলির কথায়, ‘‘চাপাতি ও অপরাধের গন্ধ খোঁজার মধ্যে জিম্মি বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতা৷”
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিজের অনলাইন পত্রিকার কার্যালয় থেকে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন ফরিদপুরের আইনজীবী স্বপন কুমার পাল৷ তাঁর অভিযোগ, সাংবাদিক প্রবীর সিকদার ফেসবুকে একটি ‘স্ট্যাটাস’ দিয়ে বলেছেন যে, তাঁর যদি মৃত্যু হয়, তাহলে তার জন্য তিনজন দায়ী থাকবেন৷ এর মধ্যে প্রথম নামটি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের, যিনি আবার প্রধানমন্ত্রী আত্মীয়৷ তাই এই মামলাটির মধ্যে মন্ত্রীর নির্দেশ যে আছে, তা অনেকের কাছেই পরিষ্কার হয়ে গেছে ৷
প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে সোচ্চার হন সাংবাদিক ও প্রগতিশীল সব শ্রেণির মানুষ৷ স্বাধীনতাযুদ্ধে ১৪ জন স্বজন হারানো এই সাংবাদিকের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করেন সাংবাদিকরা৷ অবশেষে রিমান্ডের মধ্যেও বৃহস্পতিবার তাঁকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়৷ তবে সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশেই সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে মুক্তি দেয়া হয়েছে বলে অনেকে মতামত প্রকাশ করেছেন৷
প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তারের রেশ কাটতেই না কাটতেই তার পরের দিন বুধবার গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপারর্সনের উপদেষ্টা শওকত মাহমুদ৷ তাকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত, যদিও রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তাকে৷ রাজনৈতিক কর্মসূচির পালনের সময় তিনি গ্রেপ্তার হন৷ তবুও তাঁর গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছেন সব পক্ষের সাংবাদিকরা৷ তার মুক্তিও দাবি করা হয়েছে৷
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল জানান, সাংবাদিকতার বাইরেও শওকত মাহমুদের আরো দু’টি পরিচয় আছে৷ তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এবং কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলা বিএনপির সভাপতি৷ সে কারণে তাঁর মামলাটা রাজনৈতিক৷ সুতরাং এই মামলা নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই৷ তবে সাংবাদিক সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমার একটাই চাওয়া যে, শওকত মাহমুদের সঙ্গে যেন মানবিক আচরণ করা হয়৷ তিনি অসুস্থ, ডায়বেটিসে ভুগছেন৷ তাঁর চিকিৎসার সুব্যবস্থা যেন করা হয় সে প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন এই সাংবাদিক নেতা৷ শওকত মাহমুদের গ্রেপ্তার নিয়েও সোচ্চার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক জানান, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বললে প্রবীর সিকদারের পাশাপাশি সাংবাদিক শওকত মাহমুদের কথাও বলতে হবে৷ যদি আমরা তা বলতে না পারি, তাহলে ধরে নেব, আমরা সবার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নই৷ তবে এ কথাও ভুলে যাইনি যে, তিনি নিছক সাংবাদিক নন, তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা, যে বিএনপি গণতন্ত্র চেয়ে, অগণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছে৷
একই দিন গত বুধবার দুপুরে জাতীয় পরিচয়-পত্রের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে টেলিভিশন চ্যানেল-২৪ এর রিপোর্টার জি এম মুস্তাফিজুল আলম ও ক্যামেরাম্যান রিপু আহমেদকে মারধর ও তাদের ক্যামেরা ভাঙচুর করা হয়।
গত বুধবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সংগঠনটির দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি জানান, বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা এক নজিরবিহীন আক্রমণের সম্মুখীন৷ একদিকে চাপাতিধারী উগ্রপন্থি, অন্যদিকে অপরাধের গন্ধ খুঁজে বেড়ানো সরকার৷ উভয়ের মাঝে বাকস্বাধীনতা যেন জিম্মি৷ ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারের কারণে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের হাতে পাঁচজন ব্লগার খুন হয়েছেন৷ ধর্মনিরপেক্ষতাকে উগ্রপন্থিরা ‘ইসলামবিরোধী’ হিসেবে বিবেচনা করে৷ এ মাসের শুরুর দিকে ব্লগার নীলাদ্রি চট্রোপাধ্যায় হত্যাকাণ্ডের পর, আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আনসারুল্লাহ বাংলাটিম নামে একটি উগ্রপন্থি দল দায় স্বীকার করে৷ তারা সতর্ক করে দিয়ে বলে, ভবিষ্যতেও এমন হামলা আরও ঘটবে৷ নীলাদ্রি ও অন্যান্য নিহত ব্লগারের ওপর হুমকির বিষয়টি পুলিশ জানতো, কিন্তু তাঁদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয় তারা৷
প্রতিক্ষণ/এডি/এমএস